শয়তান শব্দটি একবচন, এবং বহুবচন হচ্ছে শায়াতিন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ৬৩ বার শয়তান শব্দটি এসেছে এবং ১৮ বার শায়াতিন শব্দটি এসেছে। পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য প্রধান দুশমন হচ্ছে শয়তান। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে অসংখ্যবার শয়তানের ব্যপারে মানব জাতিকে সতর্ক করেছেন।
সূরাহ বাকারার ২০৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা সম্পূর্ণরূপে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পথ অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”
আসুন জেনে নেই শয়তানের প্রধান প্রধান কাজগুলো কি? কিভাবে শয়তান গোটা মানবজাতিকে তার পথে নিয়ে আসে?
সুচীপত্র
শয়তানের প্রধান ১০ টি কাজ
মহান আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হয়ে শয়তান পৃথিবীতে এসে মানবজাতিকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছে। অভিশপ্ত ও বিতারিত শয়তান কিভাবে মানবজাতির সাথে প্রতারনা ও বিপথে পরিচালনা করে আজ সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
১. প্ররোচনা দেয়া
শয়তান সর্বপ্রথম ধোঁকা দেয় আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এবং আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ) কে। জান্নাতে যখন তাঁরা বসবাস করছিলো তখন শয়তান তাদেরকে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে উৎসাহ দিয়েছিল।
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরাহ আরাফের ২১ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“অতঃপর শয়তান তাদের উভয়কে প্ররোচিত করলো, যেন তাদের অঙ্গ যা পরস্পরের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের সৃষ্টিকর্তা তোমাদেরকে এ গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেননি, সেটা এ কারণে যে, যেন তোমরা ফেরেশতা না হয়ে যাও কিংবা এখানকার চিরস্থায়ী বাসিন্দা না হয়ে যাও। শয়তান তাদের সামনে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যয়ই তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী”
মহান রাব্বুল আলামিন সূরাহ ত্বহার ১২০ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“অতঃপর শয়তান তাদেরকে কুপ্রস্তাব দিল। বলল হে আদম! আমি কি তোমাকে অনন্তকাল জীবিত থাকার গাছের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা বলে দেব?”
২. মানুষকে বিপথে পরিচালনা করা
শয়তান মানুষকে প্রবঞ্চনা এবং মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার মাধ্যমে বিপথে পরিচালনা করে থাকে। শয়তানের প্রধান কাজ হলো মানব জাতিকে মহান আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতায় লিপ্ত করা।
সূরাহ নিসার ১১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“وَلأُضِلَّنَّهُمْ وَلأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ وَمَن يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِّن دُونِ اللّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا”
অনুবাদঃ “তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দেব; তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়”
৩. মানুষকে ধোঁকা দেয়া
শয়তানের প্রধান প্রধান কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানব জাতিকে ধোঁকা দেয়া। শয়তান সর্বপ্রথম ধোঁকা দেয় আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এবং আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ) কে। মহান আল্লাহ তায়ালা আদম (আঃ) এবং হাওয়া (আঃ) কে নিষিদ্ধ গাছের নিকট যেতে নিষেধ করেছিলেন।
কিন্তু শয়তান তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার মাধ্যমে এবং মিথ্যা কথা বলে সে গাছের ফল খেতে উৎসাহ প্রদান করেছিলো। ফলে মহান আল্লাহ তায়ালা উভয়কেই জান্নাত থেকে বের করে দিলেন এবং একে অপরের শত্রু বানিয়ে দিলেন।
৪. অশ্লীল ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়া
নিকৃষ্ট এবং জঘন্য কাজগুলোকে শয়তান মানব জাতির সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে, মনে হবে যে এই কাজগুলোকে থেকে উত্তম ও আকর্ষণী কাজ আর একটিও পৃথিবীতে নেই।
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরাহ বাকারার ১৬৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“অবশ্যই শয়তান তোমাদেরকে অশ্লীল ও খারাপ কাজের নির্দেশ প্রদান করে। আর তোমরা যেন আল্লাহর সম্পর্কে এমন কথা বলো যা তোমরা জান না”
৫. নিজের দলে অন্তর্ভুক্ত করা
শয়তানের প্রধান প্রধান কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সে মানুষকে নিজের দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে থাকে।
সূরাহ মুজাদালার ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে। অতঃপর, আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।”
৬. সঠিক পথ থেকে সরিয়ে নেয়া
শয়তান মানব জাতিকে সঠিক, সহজ এবং সরল পথ থেকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে।
এ সম্পর্কে সূরাহ আরাফের ১৬ এবং ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“শয়তান বলল, আপনি যেমন আমাকে বিতারিত করেছেন তেমনি আমিও তাদের জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকবো। অতঃপর তাদের কাছে আসব সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, বাম দিক থেকে, ডান দিক থেকে। আপনি তাদের বেশির ভাগের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা পাবেন না।”
৭. মানুষের শিরা উপশিরায় চলাচল করা
শয়তান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন সে যেন মানুষের শিরা উপশিরায় বিচরন করতে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই ক্ষমতা প্রদান করেন। এবং আল্লাহ বলেন তবুও তুমি আমার অনুগত বান্দাকে বিপথে পরিচালিত করতে পারবে না।
শয়তান আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছে, যেভাবেই হোক মানব জাতিকে সে বিপথে পরিচালিত করবেই।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন,
“অবশ্যই শয়তান মানুষের শিরা উপশিরায় বিচরন করে।” (বুখারী, হাদিস নম্বর ১২৮৮)
৮. পাপকে করে তোলে সৌন্দর্যমণ্ডিত
মানব জাতিকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য শয়তানের প্রধান হাতিয়ার গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাপকে সে অনেক বেশি সুন্দর করে তোলে।
সূরাহ হিজর এর ৩৯-৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“শয়তান বলল, হে আমার প্রতিপালক, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তোমার বান্দাদের পৃথিবীতে নানা রকম সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করবো, এবং আপনার মনোনীত বান্দা ছাড়া তাদের সবাইকে বিপথে পরিচালিত করবো।”
৯. ইবাদত বন্দেগীতে ব্যঘাত সৃষ্টি করা
মানুষ যখন মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করার জন্য দাড়িয়ে যায় তখন শয়তান ইবাদতের মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে থাকে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে যেন মানুষ পুণ্য থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে আল্লাহর বান্দাদের আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
মুসলিম শরীফের একটি হাদিসে এসেছে,
“উসমান ইবনে আবুল আস (রাঃ) একবার মহানবী (সাঃ) এর কাছে আরজ করলেন, বললেন হে আল্লাহর রাসুল, শয়তান আমার নামাজ এবং আমার কিরাতের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এবং এতে ইবাদতে জটিলতা সৃষ্টি করে তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি যখন শয়তানের উপস্থিতি টের পাবে তখন তার কুমন্ত্রণার হাত থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে এবং তোমার বাম দিকে তিন বার থু থু নিক্ষেপ করবে।”
১০. প্রভাব বিস্তার করা
শয়তান যেসব হাতিয়ারের মাধ্যমে মানব জাতিকে গোমড়া করে তোলে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রভাব বিস্তার করা। সকল মানব সন্তানের উপর নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রয়েছে শয়তানের। সে তার নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আদম সন্তানের উপর শয়তানের একপ্রকার কুপ্রভাব রয়েছে। ঠিক তেমনি ফেরেশতাদেরও রয়েছে ভালো প্রভাব। শয়তানের প্রভাব হলো সত্যকে মিথ্যায় রূপ দেয়া এবং অকল্যাণের ওয়াদা দেয়া আর ফেরেশতার প্রভাব হলো সত্যের প্রতি সমর্থন দেয়া এবং কল্যানের প্রতিশ্রুতি দেয়া।
সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যানের অবস্থা উপলব্ধি করবে সে যেন মনে করে সেটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে, কাজেই তখন তার উচিৎ হবে মহান আল্লাহর প্রশংসা করা। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করবে, সে যেন মহান আল্লাহর কাছে শয়তানের প্রভাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে।
অতঃপর, নবী (সাঃ) একটি আয়াত পাঠ করে, শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং খারাপ কাজের নির্দেশ দেয়।”(সহিহ মুসলিম)
পরিশেষে বলা যায়, যেহেতু শয়তান আমাদেরকে বিপথে পরিচালনা করার জন্য সব ধরণের চেষ্টা করছে তাই শয়তানের কুপ্রভাব হতে, শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া উচিৎ। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে রক্ষা করবেন
আরও পড়ুন,
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের শারীরিক উপকারিতা
২. রাতে ঘুমানোর পূর্বে ইসলামের আলোকে কিছু কাজ
৩. জুমার দিনে যে কাজগুলোর মর্যাদা সবচেয়ে বেশি